বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

নগদ কেলেঙ্কারি: অর্থনৈতিক জবাবদিহিতায় নতুন পরীক্ষা

নগদ কেলেঙ্কারি: অর্থনৈতিক জবাবদিহিতায় নতুন পরীক্ষা
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলাদেশের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-কে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে যে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়—পুরো দেশের ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, নগদের সাবেক ম্যানেজমেন্ট প্রায় ২০০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং কৌশলে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে, যা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ।

প্রথমত, বিষয়টির ভয়াবহতা কেবল টাকার অঙ্কেই সীমাবদ্ধ নয়—এখানে রয়েছে নৈতিকতা, সুশাসন ও ডিজিটাল অর্থনীতির স্বচ্ছতার প্রশ্ন। সরকার যখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র মানুষের জন্য ভর্তুকি বা সহায়তা পাঠাচ্ছিল, তখন সে অর্থের একাংশ ডিজিটাল চ্যানেল ব্যবহার করে বিতরণ করা হতো। অথচ সেই প্ল্যাটফর্ম থেকেই জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাৎ হয়, যা চূড়ান্ত অর্থে সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য অনুযায়ী, পুরোনো ম্যানেজমেন্ট অবৈধভাবে ই-মানি তৈরি করেছে—যার পরিমাণ প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। মূলত বাস্তবে কোনো অর্থ ছাড়াই এই ডিজিটাল টাকা তৈরি করে সিস্টেমে দেখানো হয়েছে। এটি সরাসরি অর্থনৈতিক জালিয়াতি, যা পুরো ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ভেঙে দিতে পারে।

তৃতীয়ত, এই ঘটনায় প্রশাসনিক জটিলতা এবং আদালতের দ্বিধান্বিত অবস্থানও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ করলেও আদালতের আদেশে পুরোনো ম্যানেজমেন্ট আবার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে। এটি একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, অন্যদিকে দুর্নীতিবাজদের জন্য এক প্রকার 'পুনর্বাসন'ও নিশ্চিত করে।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নতুন করে সতর্কতা অবলম্বন করেছে—ব্যাংকগুলোকে সীমিত লেনদেনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটির ডাটাবেজ মুছে ফেলার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন গভর্নর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতদিনে কী ধরনের পর্যবেক্ষণ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের? এবং আগেভাগেই কেন এ ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি?

এ ঘটনায় শুধু অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করে দায় শেষ করা যাবে না। এটি হতে হবে একটি উদাহরণমূলক মামলার সূচনা, যেখানে আইনের চোখে সবকিছু পরিস্কারভাবে বিচার করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে ডিজিটাল ফিনটেক খাতে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই যাবে।

রাষ্ট্র ও ব্যবস্থার করণীয়:

১. স্বচ্ছ ও দ্রুত বিচার: এই মামলার বিচার যাতে দীর্ঘসূত্রতায় না পড়ে, সেজন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ প্রয়োজন।

২. ডিজিটাল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরীক্ষা জোরদার: নিয়মিত ও রিয়েল-টাইম অডিট, স্বয়ংক্রিয় সতর্কতা ব্যবস্থা এবং কেন্দ্রীভূত মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

৩. ডেটা সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন: যেহেতু ডাটাবেজ মুছে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে, তাই দেশের সমস্ত ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠানে শক্তিশালী তথ্য সুরক্ষা নীতিমালা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

সবশেষ ‘নগদ কেলেঙ্কারি’ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়ালেও জবাবদিহিতা, সুশাসন এবং নৈতিকতা ছাড়া অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে, একই সঙ্গে বিচার বিভাগকে জনস্বার্থে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এ ঘটনার সুবিচার শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, দেশের সমগ্র ডিজিটাল অর্থনীতির বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন