বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

শেয়ারবাজারের টালমাটাল অবস্থা: আস্থা ফেরাতে চাই সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ

শেয়ারবাজারের টালমাটাল অবস্থা: আস্থা ফেরাতে চাই সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বর্তমানে এক ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই বাজারে একের পর এক দরপতন এবং ক্রমাগত লেনদেন হ্রাসের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রোববার (২৫ মে) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন নেমে এসেছে মাত্র ২৩৫ কোটি ৫১ লাখ টাকায়—যা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সর্বনিম্ন এবং ২০২০ সালের করোনা মহামারিকালীন সময়ের পরে এটাই সবচেয়ে বাজে চিত্র।

শেয়ারবাজারের পতনের সাথে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘমেয়াদি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে ছাত্র ও জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে। এর পরপরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়। সরকার পরিবর্তনের পর প্রথমদিকে বাজারে কিছুটা ইতিবাচক সাড়া দেখা গেলেও, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাজার আবার নেতিবাচক ধারায় ফিরে যায়।

এই ধাক্কা শুধু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকেই আসেনি—বরং নতুন সরকারের অর্থনৈতিক রূপরেখা ও বিনিয়োগবান্ধব নীতির ঘাটতির কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকর হস্তক্ষেপ না থাকায় পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বর্তমানে ৪৭৩৬ পয়েন্টে এসে ঠেকেছে, যা ২০২০ সালের ১৯ আগস্টের পর সর্বনিম্ন। সেই সঙ্গে ডিএসই শরিয়াহ সূচক নেমে এসেছে ১০৩২ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক অবস্থান করছে মাত্র ১৭৪৬ পয়েন্টে। একযোগে সব সূচকের পতন বাজারের গভীর অসুস্থতার বার্তা দিচ্ছে।

শুধু সূচক নয়, তালিকাভুক্ত কোম্পানির দরেও পড়েছে বড় ধরনের ধস। রোববার দিন শেষে ৩৯৬টি ট্রেড হওয়া কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১০০টির শেয়ারের দাম বেড়েছে, বিপরীতে ২১৫টির দাম কমেছে এবং ৮১টির অবস্থান অপরিবর্তিত। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, ভালো মানের কোম্পানিগুলোর (১০% বা তার বেশি লভ্যাংশ প্রদানকারী) মধ্যে ১২৮টির শেয়ার দাম কমেছে, যা বিনিয়োগকারীদের হতাশার কারণ।

এই সংকটের পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করা যায়:
১. নীতিনির্ধারণী অস্থিরতা ও অনির্দেশ্যতা: অন্তর্বর্তী সরকার শেয়ারবাজার বিষয়ে কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়নি। বিনিয়োগকারীরা বুঝে উঠতে পারছে না, বাজারে ভবিষ্যতে কী ধরনের নীতিমালা আসতে পারে।

২. বাজারে স্বচ্ছতার অভাব: অনেক কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন অস্বচ্ছ এবং সময়মতো প্রকাশ না হওয়া, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।

৩. বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস: রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইছে না।

৪. মূল্যায়ন সংকট: বহু কোম্পানির শেয়ার অযৌক্তিকভাবে মূল্যায়িত, ফলে বাজারে সত্যিকার মূল্যায়নের ভিত্তিতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমে গেছে।

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কেবল মুখস্ত আশ্বাস নয়, বরং শক্তিশালী ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। নিচে কয়েকটি কার্যকর সুপারিশ তুলে ধরা হলো:

১. বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা: কোম্পানিগুলোর আর্থিক বিবরণী নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্যভাবে প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্বল কোম্পানিকে বাজার থেকে বাদ দেওয়া বা পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন।

২. বিনিয়োগবান্ধব নীতির ঘোষণা: কর কাঠামো সহজীকরণ, বিদেশি বিনিয়োগে প্রণোদনা, স্ট্যাম্প ডিউটি হ্রাসসহ পলিসি রিল্যাক্সেশন দরকার।

৩. বাজারে মুদ্রা ও সুদের হারের ভারসাম্য রক্ষা: উচ্চ সুদের হার বাজার থেকে তরলতা সরিয়ে নিচ্ছে। এই ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি।

৪. শেয়ারবাজারে প্রণোদনা প্যাকেজ: সরকার চাইলে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট খাতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে।

৫. বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কার্যকর ও নিরপেক্ষ ভূমিকা: নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

সবশেষ শেয়ারবাজার শুধু ব্যবসায়িক একটি ক্ষেত্র নয়; এটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। বাজারের প্রতিটি উত্থান-পতন সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে অর্থনীতির মূলধারায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

বর্তমানে বাজারের যা পরিস্থিতি, তাতে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে যে, প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার, কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও নীতিনির্ধারণী উদ্যোগের অভাবেই আস্থা হারাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। একে অবহেলা করলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই যায়। এখনই সময় সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার—আস্থা ফেরাতে, বাজারকে পুনরুজ্জীবিত করতে।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন