আন্দোলনের নামে জনভোগান্তি; সমাধানে প্রয়োজন সুস্পষ্ট নীতিমালা ও সমন্বিত পদক্ষেপ


রাজধানী ঢাকা আজকাল যেন প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও শ্রমজীবী সংগঠন একের পর এক দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামছে।
সচিবালয়, যমুনা, শাহবাগ, কাকরাইল, মৎস্য ভবন কিংবা নগর ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি ও অবরোধের কারণে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীবাসী চরম যানজট ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) একাধিকবার গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসব নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে না। আন্দোলনকারীরা নির্ধারিত সীমারেখা না মানায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, আর সাধারণ জনগণের জীবনে নেমে আসছে দুর্ভোগের ছায়া। যাত্রীরা যানজটে আটকে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, কেউ কেউ পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হচ্ছে, পরিবহন শ্রমিকরা আয় হারাচ্ছেন, চাকরিজীবীরা সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে পারছেন না। এটি শুধু জনজীবন নয়, অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এখানে প্রশ্ন উঠে, ডিএমপির গণবিজ্ঞপ্তি যদি কার্যকর না হয় তবে তার উদ্দেশ্য কতটা ফলপ্রসূ? এবং বারবার এই ব্যর্থতার পেছনে মূল কারণ কী?
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, সরকার শুরু থেকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও দাবি-দাওয়াভিত্তিক আন্দোলনের প্রতি সহনশীল আচরণ দেখিয়েছে। এই অবস্থান অবশ্যই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু যখন এই অধিকার চর্চার ফলে জনদুর্ভোগ ঘটে, তখন প্রয়োজন হয় বাস্তবতাসম্মত একটি ভারসাম্য। এখানে স্পষ্ট একটি নীতির অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে জনস্বার্থ ও আন্দোলনের অধিকার একে অপরকে বাধাগ্রস্ত না করে সহাবস্থান করতে পারে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই সরকারের দায়িত্ব। একই সঙ্গে জনজীবনের স্বাভাবিক চলাচল ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করাও সরকারেরই দায়িত্ব। তাই শুধু গণবিজ্ঞপ্তি জারি করলেই দায় শেষ হয় না; বরং প্রয়োজন এই নীতিমালার প্রয়োগযোগ্যতা ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা গড়ে তোলা।
এখানে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় উঠে আসে:
১. আন্দোলনের জন্য নির্ধারিত স্থান: সভা-সমাবেশের জন্য রাজধানীর বাইরে বা নগরের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে বিকল্প এবং সুপরিকল্পিত জায়গা নির্ধারণ করা উচিত, যেখানে আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দাবি তুলে ধরতে পারেন এবং জনজীবন ব্যাহত না হয়।
২. আন্দোলন পর্যবেক্ষণ ও সংলাপ উদ্যোগ: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শুধু অবরোধ ঠেকানো নয়, বরং আন্দোলনের মূল কারণ বিশ্লেষণ করে আগেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা জানানো এবং সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতা করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. জনসচেতনতা ও মিডিয়া ব্যবস্থাপনা: জনগণকে আগে থেকে তথ্য দিয়ে সতর্ক করা, বিকল্প রুট নির্ধারণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে ট্রাফিক আপডেট নিশ্চিত করা হলে দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
৪. আইন প্রয়োগে সমন্বয় ও প্রস্তুতি: পুলিশের মাঝে সমন্বয়হীনতা দূর করে তাদের কার্যকর উপস্থিতি এবং প্রশিক্ষিত রেসপন্স ইউনিটের মাধ্যমে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি।
সর্বোপরি, সরকারকে এখনই একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে দাবি-দাওয়া শোনা হয়, সমাধানের পথে এগোনো হয় কিন্তু তা জনজীবনের ভার বহনযোগ্যতার সীমা অতিক্রম না করে।
প্রতিদিন রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করা যেমন একটি সমস্যার সমাধান নয়, তেমনি নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করে জনজীবনে স্বস্তি ফেরানোর চেষ্টা আরও বড় বিপর্যয়ের সূচনা হতে পারে। এই দোদুল্যমান অবস্থান থেকে বের হয়ে একটি সুসমন্বিত, ভারসাম্যপূর্ণ এবং কার্যকর নীতির দিকে এগোনোই এখন সময়ের দাবি।
