বন্যার পূর্বাভাস: ঝুঁকিতে ছয় জেলা, প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই


বাংলাদেশ, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও জলবায়ুজনিত দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্ষা মৌসুমের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই বন্যা যেন এক অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দেখা দেয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী দেশের ছয়টি জেলায় এবারও বন্যা পরিস্থিতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর ও ফেনীসহ বেশ কয়েকটি জেলার নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া এসব জেলার নিম্নাঞ্চলসমূহে বন্যা পরিস্থিতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক খবর।
বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিভাগের মুহুরী, গোমতী ও ফেনী নদীর পানি বৃদ্ধি এবং সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সারিগোয়াইন, যাদুকাটা, মনু, ধলাই ও খোয়াই নদীগুলোর বিপৎসীমা অতিক্রম করার পূর্বাভাস আমাদের আগাম সতর্ক করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে রংপুর বিভাগের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
প্রতিবছর বর্ষা এলেই আমরা বন্যার খবর শুনি। প্রতিবারই সরকারি সংস্থা পূর্বাভাস দেয়, সংবাদমাধ্যম তা প্রচার করে, মানুষ আতঙ্কিত হয়, কোথাও কোথাও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় কতটা কার্যকর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে এই পূর্বাভাসের আলোকে?
বন্যা আমাদের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি, ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কৌশল এবং জনগণকে সচেতন করার কাজগুলো এখনও অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত। সরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে আরও সক্রিয় হতে হবে।
নদীভাঙন, ফসলের ক্ষতি, ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া, পানিবাহিত রোগের বিস্তার- সব মিলিয়ে বন্যা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এটি অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়েরও কারণ। এ কারণে আগাম প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।
সরকারি পর্যায়ে এখনই জরুরি ভিত্তিতে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ মজুদ, আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ এবং তথ্য আদান-প্রদানে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস অনুযায়ী কিছু নদীর পানি সমতলে হ্রাস পেতে পারে—এটি স্বস্তির খবর হলেও, তা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চয়তা দেয় না।
বারবারের বন্যা কেবল মৌসুমি ঘটনাই নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের একটি পরিণতিও বটে। হিমালয়ের হিমবাহ গলে যাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্য হ্রাস—সব মিলিয়ে এই দুর্যোগ আরও তীব্র ও অপ্রত্যাশিত হয়ে উঠছে। এখনই যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।
সবশেষ বন্যা এলে কেবল করুণা নয়, কার্যকর ব্যবস্থা চাই। শুধু পূর্বাভাস জানানোই যথেষ্ট নয়—তার চেয়েও জরুরি হলো ব্যবস্থা নেওয়া, সমন্বিত প্রস্তুতি থাকা এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই ছয় জেলার মানুষ যেন আরও একটি ‘দুর্যোগ’ নয়, বরং ‘দায়িত্বপূর্ণ প্রস্তুতি’ প্রত্যক্ষ করতে পারে—এই প্রত্যাশাই রইল।
