প্রশাসনের অস্থিরতা: নেতৃত্বহীনতার ফলাফল


একটি রাষ্ট্রের প্রশাসন যদি শৃঙ্খলাবিহীন, দ্বিধান্বিত ও স্থবির হয়ে পড়ে, তবে সে রাষ্ট্রের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ আজ এমন এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে রাজনৈতিক পালাবদলের দশ মাস পরও প্রশাসন কাঙ্ক্ষিত স্থিতি খুঁজে পায়নি। বরং সময় যতই গড়াচ্ছে, অরাজকতা ততই বিস্তৃত হচ্ছে। শৃঙ্খলার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা, কর্মতৎপরতার বদলে স্থবিরতা এবং জনসেবার স্থলে বেড়েছে আত্মরক্ষার মনোভাব।
নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল, একটি দক্ষ, নিরপেক্ষ এবং মেধাভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নেতৃত্ব বাছাইয়ে অদূরদর্শিতা, যোগ্যতার চেয়ে পছন্দকে অগ্রাধিকার আর নীতিগত স্থিরতার অভাব। এই তিনটি কারণ মিলেই আজকের অচলাবস্থার জন্ম দিয়েছে।
প্রশাসনের শীর্ষ পদে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে মেধাবী হলেও প্রশাসনিক বাস্তবতা এবং সংকট মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতার অভাব, তাদের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট। নেতৃত্বের এই দুর্বলতা গোটা কাঠামোকে হতাশ করেছে। কর্মীরা সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাচ্ছেন, অধস্তনরা নির্দেশনা পাচ্ছেন না, আবার যেটুকু সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা ঘন ঘন পরিবর্তনের শিকার।
এই নেতৃত্ব সংকটের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’। এমন এক সময়, যখন প্রশাসন পুনর্গঠনের মাধ্যমে আস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার ছিল, তখন এই আইন অধিকাংশ সরকারি কর্মচারীর কাছে প্রতিকূল ও দমনমূলক মনে হয়েছে। এই আইন বাতিলের দাবিতে সচিবালয়সহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাগাতার আন্দোলনে রয়েছেন। আন্দোলনের ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। জনসাধারণের জন্য ন্যূনতম সেবা প্রাপ্তিও এখন দুরূহ হয়ে পড়েছে।
আরও গভীর সংকট তৈরি করেছে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈষম্যজনিত বিরোধ। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই অসন্তোষ আজ প্রকাশ্যে বিস্ফোরিত হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া আধিপত্য, পদোন্নতিতে বৈষম্য এবং সুযোগ-সুবিধার অসাম্যতা প্রশাসনিক ঐক্য ও সমন্বয়কে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এখন অনেক ক্ষেত্রেই সহযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা এবং বিরুদ্ধতা কাজ করছে।
এই অচলাবস্থা শুধুমাত্র দাপ্তরিক সীমায় সীমাবদ্ধ নেই। এর পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে উন্নয়ন কার্যক্রম, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরও। অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ, ফাইল আটকে আছে মন্ত্রণালয়ে, মাঠ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কর্মকর্তারা। এমনকি জরুরি সেবা নিশ্চিত করতেও ব্যর্থতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো দক্ষ ও সাহসী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং দায়িত্বশীলতা বিবেচনায় নিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে। দলীয় আনুগত্য নয়, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতাই হোক নিয়োগ ও পদোন্নতির মূলনীতি।
এছাড়া প্রশাসনিক সংস্কার এমনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, যা প্রশাসনের কর্মীদের মধ্যকার আস্থা ও ঐক্য পুনরুদ্ধার করে। চাকরি সংশোধন আইনসহ অন্যান্য বিতর্কিত সিদ্ধান্ত পুনরালোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাতে হবে।
প্রশাসনের সংকট শুধু একটি কাঠামোগত দুর্বলতা নয়, এটি রাষ্ট্রের সার্বিক সক্ষমতার প্রতিচ্ছবি। এই সংকট যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই জনগণের আস্থা হ্রাস পাবে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই সরকারের উচিত, অতিসত্বর সমন্বিত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে প্রশাসন তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পায় এবং রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা হিসেবে কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।
