ধোঁয়ার শহর ঢাকা: শ্বাস নেওয়াও যেন এখন সংগ্রাম


রাজধানী ঢাকায় যে হারে কালো ধোঁয়া নির্গত করে ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল করছে, তা শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। প্রতিদিন শহরের রাস্তায় দাঁড়ালেই আমরা চোখে দেখি—মিনিবাস, ট্রাক, পুরোনো বাস থেকে নির্গত হচ্ছে ঘন কালো ধোঁয়া। এই ধোঁয়া কেবল দৃষ্টিকে অস্পষ্ট করছে না, মানুষের ফুসফুসেও রেখে যাচ্ছে বিষাক্ত ছাপ।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস এসব যানবাহন। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশের সড়কে চলা অন্তত ৬ লাখ ৬৫ হাজার যানবাহনের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। তার মধ্যে একটি বড় অংশ রাজধানী ঢাকায় চলাচল করছে অনায়াসে। ২০-২৫ বছরের পুরোনো ইঞ্জিনচালিত এসব গাড়ি শুধুই পরিবেশ নয়, বরং দুর্ঘটনারও বড় ঝুঁকি হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন ওঠে—এত বিপুলসংখ্যক অবৈধ গাড়ি কীভাবে চলছে? কীভাবে তারা ফিটনেস সার্টিফিকেট পায়? কেন তারা বছরের পর বছর ধরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে? উত্তরে মেলে—‘ম্যানেজমেন্ট’। দুর্নীতির ছত্রছায়ায় বিআরটিএ থেকে শুরু করে সড়ক ব্যবস্থাপনার নানা স্তরে অসংখ্য ফাঁকফোকর গড়ে উঠেছে, যার সুযোগ নিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিটনেস পরীক্ষার নামে যে ‘৫৯ দফা’ চেকলিস্টের কথা বলা হয়, বাস্তবে তার সিংহভাগই কেবল কাগজে-কলমে থেকে গেছে। যার বাস্তব রূপ আমরা দেখি যখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে চোখ-মুখ ঢেকে রাখি ধোঁয়ার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য।
এর চেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, বায়ুদূষণের এই চক্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু, গর্ভবতী নারী, প্রবীণ, এবং সড়কের পাশে কাজ করা মানুষ—যেমন ট্রাফিক পুলিশ, হকার, রিকশাচালক। গবেষণা বলছে, দূষিত বাতাস গর্ভস্থ শিশুর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত করতে পারে। প্রতি বছর দূষণের কারণে বাংলাদেশে ১ লাখের বেশি মানুষ অকাল মৃত্যুর শিকার হন, যার অর্ধেকেরও বেশি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাসিন্দা।
অথচ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দৃশ্যমান কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেই। বিআরটিএ মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট চালিয়ে কিছু জরিমানা করে, দু-একটি গাড়ি ডাম্পিং করে—তবে বাস্তব সমস্যা থেকে যায় একই জায়গায়। সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত যেমন ২৫ বছরের বেশি পুরোনো গাড়ি রাস্তায় না নামানোর ঘোষণাও ধোপে টেকেনি। পরিবহন মালিকদের চাপে সেই সিদ্ধান্তও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমরা যদি পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনাকে সমান্তরালে এগিয়ে নিতে চাই, তবে বায়ুদূষণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে, ফিটনেসবিহীন ও কাগজপত্রবিহীন গাড়িকে রাস্তায় চলাচল থেকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা। দ্বিতীয়ত, বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গড়ে তুলে, তথ্যভিত্তিক নজরদারি বাড়াতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং প্রযুক্তিনির্ভর ফিটনেস যাচাই ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ডিজিটাল ডাটাবেইসের মাধ্যমে পুরোনো ও দূষণকারী যানবাহন চিহ্নিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের নিবন্ধন ও চলাচল রোধ করা সময়ের দাবি।
যানবাহনের কালো ধোঁয়ার ছায়া থেকে ঢাকাকে মুক্ত করতে চাইলে এখনই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক কঠোরতা প্রয়োজন। না হলে এই নগর একদিন শুধুই ধোঁয়ার শহর হয়ে উঠবে—যেখানে শ্বাস নেওয়া হবে প্রতিদিনের সংগ্রাম।
