নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কুবির নতুন ক্যাম্পাসে সিএসই বিভাগের ভ্রমণ


কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) অধিকতর সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন নতুন ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসযোগে সেখানে ভ্রমণের ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসন বলছে, এ বিষয়ে তাদের কিছু জানানো হয়নি। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে চলছে তুমুল সমালোচনা।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকাল ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের নবীন শিক্ষার্থীরা সেখানে পরিদর্শনে গেলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
জানা যায়, গতকাল ৩ জুলাই সিএসই বিভাগের ছাত্র পরামর্শক ও প্রভাষক মো. জাহিদুর রহমান এবং অন্য দুই প্রভাষক জহিরুল ইসলাম বাবর ও মো. আতিকুর রহমানের তত্ত্বাবধানে বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন ক্যাম্পাস পরিদর্শনে যান। এরআগে গত ১ জুলাই বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলে বাস বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে গতকাল ৩ জুলাই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসযোগে নির্মাণাধীন নতুন ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেন।
এনিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝেও দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তাদের দাবি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবিক ঘটনাগুলোতেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাস সহায়তা দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু সিএসই বিভাগের নবীন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার মাত্র তৃতীয় দিনের মাথায় কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস বরাদ্দ পায়? সেটাও আবার নির্মাণাধীন নতুন ক্যাম্পাস পরিদর্শনে! যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
এবিষয়ে আইন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বায়েজিদ হোসেন বলেন, 'কিছুদিন আগে আমার ডিপার্টমেন্টের আমার জুনিয়র একজন মেয়ে শিক্ষার্থী (তিন্নি আক্তার, আইন ৮ম ব্যাচ) মারা যায়। আমাদের ডিপার্টমেন্টসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলেই শোকাহত হয়। তার ক্লাসমেটরা তো মেনেই নিতে পারছিল না। আমরা প্রায় ৫০/৬০ জন শিক্ষার্থী ছেলে মেয়ে উদ্যোগ নেই জানাযায় যাওয়ার জন্য তখন রাত ১২টা বাজে। আমরা ডিপার্টমেন্টের স্যারদের সাথে যোগাযোগ করি, স্যাররা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করেও একটি বাস ম্যানেজ করতে পারেনি। ভিসি স্যারের সাথেও কথা বলা হয় কিন্তু তিনি রাজি হন নাই। তিনি কারণ দেখান যে অনডেতে নাকি বাস দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু তার মেয়ের জন্য ঠিকই বাস দেওয়া যায় অন ডেতে। এটা শুনার পর মনে হলো যেন আমরা এখানে ভেসে এসেছি আমাদের কোনো অধিকারই নেই। আমরা বলেছিলাম যে তেল খরচ আমরা দিবো কিন্তু তিনি বললেন অনডেতে কোনোভাবেই বাস দেওয়া যাবে না। তারপর রাত ১ টা বাজে আমরা প্রাইভেট কার ভাড়া করে তিন্নির বাড়িতে যায়।'
একইবর্ষের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদ কাউসার বলেন, 'বাস সংকটে প্রয়োজনে বাস না পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়মিত দুর্ভোগের কারণ। বিগত কয়েক মাস যাবত ঢাক-ক্যাম্পাস বাসের জন্য ভিসি স্যারের দোয়ারে ঘুরেছি আমরা। তিনি উত্তর দিতেন এটা নিয়ম বহির্ভূত। ঢাকা টু ক্যাম্পাস বাস দিলে তার প্যানশন আটকে যাবে। কিন্তু গতকাল মাত্র ক্যাম্পাসে পা রাখা একটা ব্যাচ দেখলাম ভার্সিটির বাস নিয়ে নতুন ক্যাম্পাস ট্যুরে বেরিয়েছে। শুনেছি সেই ব্যাচে ভিসি মহোদয়ের মেয়েও নাকি ভর্তি হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে এটা আমাদের জন্য পরিতাপের বিষয়। ক্ষমতার এমন অপব্যবহার চলতে থাকলে যে আশা নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছিলাম সেই স্বপ্নের বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে নাহ।'
এবিষয়ে পরিবহন পুলের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. মোশারফ হাসান ভুঁইয়া বলেন, “বিভাগীয় প্রধানের স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনের ভিত্তিতে আমি বাস দিয়েছি। আমাদের নিয়ম অনুযায়ী, যদি শিডিউলে ব্যাঘাত না ঘটে এবং গন্তব্য শহরের আশপাশে হয়, তাহলে পরিবহন পুল থেকেই বাস অনুমোদন দেওয়া যায়, রেজিস্ট্রার দপ্তরের প্রয়োজন হয় না। শিক্ষকরা কোথায় যাচ্ছেন, তা জিজ্ঞাসা করার এখতিয়ার আমার নেই, তাই তারা নতুন ক্যাম্পাসে যাবেন—এ তথ্য আমি জানতাম না। তবে নিষিদ্ধ এলাকায় যাওয়ার জন্য বাস চাওয়া হলে, সেটা কেনো করা হলো, সে প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদেরই করা উচিত।”
জানা যায়, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে সিএসই বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: হায়দার আলীর মেয়ে সদ্য ভর্তি হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকের দাবি তাকে অতিরিক্ত সুবিধা দিতেই এই ধরণের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে একাধিক সূত্রে গেছে, উপাচার্যের মেয়ে গতকাল বাসযোগে নতুন ক্যাম্পাস পরিদর্শনে উপস্থিত ছিলেন না।
গত ১২ই মে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকল্প এলাকায় সর্বসাধারণের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনুমতি ব্যতীত প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ না করার নির্দেশনা দিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলের জ্ঞাতার্থে প্রতিটি বিভাগীয় প্রধান, দপ্তরপ্রধান বরাবর অনুলিপিও পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু নির্মাণাধীন নতুন ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানা ছিলো না বলে জানান বিভাগীয় প্রধান ড. মাহমুদুল হাছান। তিনি বলেন, 'নবীন শিক্ষার্থীদের যেন সিনিয়ররা বিরক্ত না করে, সে উদ্দেশ্যে বিভাগীয় আলোচনার ভিত্তিতে কিছুটা ঘোরাঘুরির সিদ্ধান্ত নেই। সেই অনুযায়ী আমরা পরিবহন দপ্তরে চিঠি দিই। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বাস শিডিউল ফাঁকা থাকায়, দূরে না যাওয়ার শর্তে একটি বাস বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সেখানে যাওয়ার অনুমতির বিষয়টি আমাদের খেয়ালে ছিল না, তাই তারা ক্যাম্পাসে ভালোভাবে ঘুরে দেখতে পারেনি।'
এনিয়ে সৃষ্ট উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সিএসই বিভাগ থেকেও তাদের ফেসবুক পেজে ইতোমধ্যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, 'নতুন ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর পরিদর্শনের অনুমতি না থাকায়, আমরা কোন ভবন বা পাহাড়ে যাইনি। বাসের সামনে ২টি গ্রুপ ছবি তুলেই আমরা আবার মূল ক্যাম্পাসে ফিরে আসি।' তবে বিভাগের ছাত্র পরামর্শক ও প্রভাষক মো. জাহিদুর রহমান বলছেন ভিন্নকথা। তিনি বলেন, 'ক্যাম্পাসের ভেতরে ডুকে বাসের সামনে ছবি তুলে পরবর্তীতে বাসে করে ক্যাম্পাসের ভেতরের রাস্তা দিয়ে পরিদর্শন করে চলে আসি।'
প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমি এখানে নতুন। সকল নিয়মকানুন ঠিকঠাকভাবে জানি না। তাই এবিষয়টি জানা ছিলো না।'
এনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হাকিম বলেন, 'বাস দেয়ার বিষয়টি পরিবহন পুল ব্যাখ্যা করবে। কারা বাস নিয়েছে এবং কীভাবে নিয়েছে, তা আমি জানি না। তবে নতুন ক্যাম্পাসে না যাওয়ার ব্যাপারে রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে সকল বিভাগীয় প্রধানকে আগেই চিঠি দেওয়া হয়েছে।'
নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাস নিয়ে শিক্ষকসহ কীভাবে প্রবেশ করলো? এমন প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, 'বাস ব্যবহারের বিষয়ে পরিবহন পুলের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা রেজিস্ট্রার দপ্তরের অনুমতি না নিয়েই বাস দিয়েছে। সম্ভবত রিকুইজিশনের ভিত্তিতে এবং দূরত্ব কম হওয়ায় শিডিউল ফাঁকা থাকায় আতিক (সেকশন অফিসার, পরিবহন পুল) অনুমোদন দিয়েছেন। তবে প্রশাসনের কেউ বিষয়টি জানতো না।'
এবিষয়ে জানতে পরিবহন পুলের সেকশন অফিসার মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার বলেন, 'পরিবহন পুলকে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে এবং বিভাগীয় প্রধানের কাছ থেকেও নিষিদ্ধ জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারে লিখিত জবাব চাওয়া হবে।'
রাফি হোসেন
