বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
অনুসন্ধান-১

মানিলন্ডারিংয়ের মূলহোতা দেলোয়ার এখনো বহাল তবিয়তে

মানিলন্ডারিংয়ের মূলহোতা দেলোয়ার এখনো বহাল তবিয়তে
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

দেশ যখন দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের কথা বলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তখন দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা অর্থপাচারকারী ও বহুল আলোচিত একাধিক অভিযোগের দেলোয়ারের অনায়াস বিচরণ সেই প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ করছে কি না এ প্রশ্ন এখন জনমনে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

তার বিরুদ্ধে রয়েছে অর্থপাচার, জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের গুরুতর অভিযোগ, যার প্রমাণ মিলেছে নানা অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রতিবেদনে। তবুও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসনের নীরবতা ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির আড়ালে থেকে দেলোয়ার রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তাঁকে নিয়ে আমাদের অনুসন্ধানী কয়েকটি প্রতিবেদনে  তুলে ধরবো বিস্তারিত। দেলোয়ারের অর্থ সাম্রাজ্যের উত্থান, এর আগে অন্য ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারী করে বর্তমানের কর্মাস ব্যাংকে চাকুরি করেন তার ফিরিস্তি। এছাড়াও প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক আশ্রয়ে তার সুরক্ষার কৌশল, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিস্ক্রিয়তার অন্তর্নিহিত কারণ। প্রশ্ন আমরা তুলব, উত্তর চাইব—দেশ কি সত্যিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, নাকি কিছু প্রভাবশালী 'অপ্রতিরোধ্য'দের জন্য নীরবতা কৌশল হয়ে উঠেছে? মানিলন্ডারিং এর মূলহোতা দেলোয়ার হোসেনকে নিয়ে আমাদের প্রথম পর্ব।

দেশজুড়ে যখন দুর্নীতি দমন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কথা বলা হচ্ছে, তখন একাধিক মানিলন্ডারিং এর মূলহোতা দেলোয়ারের অনায়াস বিচরণ ও প্রভাব বিস্তার যেন সেই প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দীর্ঘদিন ধরে অর্থপাচার, জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের অভিযোগ উঠে আসছে বারবার। প্রশ্ন উঠছে—দেলোয়ারের মতো ব্যক্তিরা কীভাবে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখনো বহাল তবিয়তে থাকতে পারেন?

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক পিএলসির প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেন বিএফআইইউ-এর সাবেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাসের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত। বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেই তিনি নিজের পরিবারের অন্য সদস্যদের অর্থশালী করে তুলেছেন। গড়েছেন নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ। এসব গুরুতর অভিযোগ মাথায় নিয়েও দেলোয়ার এখনো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে বহাল রয়েছেন।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন দেলোয়ার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাসুদ বিশ্বাস দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করলেও, দেলোয়ার এখনো কমার্স ব্যাংকে অদৃশ্য এক শক্তি হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে ব্যাংকপাড়ায় প্রচার রয়েছে। এমনকি পদোন্নতির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে দেনদরবার করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

গত সরকারের আমলে অবৈধভাবে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এই অর্থপাচার চক্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক পিএলসির প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেন। তার অন্যতম সহায়তাকারী এবং গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।

দেলোয়ার ও মাসুদ বিশ্বাস চক্রের বিরুদ্ধে পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকার ছাড় করিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনেরও একাধিক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, মাসুদ বিশ্বাসের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে কাজ করতেন দেলোয়ার। পেমেন্ট গেটওয়েতে যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির টাকা আটকে যেত, দেলোয়ার তাদের মাসুদ বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যেতেন। এরপর দরকষাকষির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সেই টাকা ছাড়ের ব্যবস্থা করতেন মাসুদ বিশ্বাস।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মাসুদ বিশ্বাস বিএফআইইউ প্রধান থাকা অবস্থায় নিজেই বিভিন্ন ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের বাঁচাতে কাজ করতেন এবং এর বিনিময়ে নিতেন মোটা অঙ্কের ঘুষ। এসব কর্মকাণ্ডে দেলোয়ার ছিলেন তার বিশ্বস্ত সহযোগী। এমন বেশ কিছু ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ওয়ালেটমিক্সের ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা ছাড়ের নাটকীয় ঘটনা

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশি ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ পাচার এবং কোম্পানির টাকা ব্যক্তিগত একাউন্টে নেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট ইউসিবি ব্যাংকের নিকুঞ্জ শাখায় থাকা ওয়ালেটমিক্স নামের একটি কোম্পানির ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা আটকে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আগেও ৪৫ কোটি ও ১৪ কোটি টাকার মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় এসব টাকা আটকে রাখা হয়।

দীর্ঘদিন তদবির করেও প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টরা টাকা ছাড়াতে ব্যর্থ হন। এরপর কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেনের সহায়তায় তারা বিএফআইইউর তৎকালীন প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সূত্র জানায়, দেলোয়ার নিজেই ওয়ালেটমিক্সের কর্মকর্তাকে মাসুদ বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান এবং ৫০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে টাকা ছাড়ের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন।

এরপর ২০২3 সালের ফেব্রুয়ারিতে মাসুদ বিশ্বাস ইউসিবি ব্যাংকের নিকুঞ্জ শাখার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করে আটকে রাখা টাকা ওয়ালেটমিক্সের একাউন্টে জমা দিতে বলেন। মাসুদ বিশ্বাসের চাপ উপেক্ষা করতে না পেরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নির্দেশ অনুযায়ী কাজটি করেন। পরে ওয়ালেটমিক্স ওই টাকা উত্তোলন করে, যার মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী প্রায় ৩ কোটি টাকা দেওয়া হয় মাসুদ বিশ্বাস ও দেলোয়ারকে।

ওয়ালেটমিক্সের এক কর্মকর্তা যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “তখন আমি প্রচণ্ড টেনশনে ছিলাম। অনেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছি কিন্তু কোথাও কাজ হচ্ছিল না। পরে একজনের মাধ্যমে কমার্স ব্যাংকের দেলোয়ারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিই আমাকে মাসুদ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করান। পরে ফিফটি পার্সেন্ট কমিশনে টাকা ছাড় করে দেন।”

ইউসিবি ব্যাংকের নিকুঞ্জ শাখার এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মাসুদ বিশ্বাস ফোন করে বলেছিলেন, টাকা ওয়ালেটমিক্সের একাউন্টে দিতে। তখন তার কথা অমান্য করার উপায় ছিল না। তবে আমি কোনো কমিশন নেইনি।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের একটি চিঠির প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর ওয়ালেটমিক্সের লেনদেন আটকে দেওয়া হয়। তবে সেই সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করেই প্রভাব খাটিয়ে টাকা ছাড়িয়ে নেওয়া হয়।

গুরু জেলে, দেলোয়ার বহাল

সরকার পরিবর্তনের পর মাসুদ বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হলেও তার অন্যতম সহযোগী মো. দেলোয়ার হোসেন এখনো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ব্যাংকপাড়ায় গুঞ্জন রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেলোয়ারের সখ্যতার কারণে তিনি বহাল তবিয়তে আছেন এবং ইতিমধ্যে পদোন্নতির জন্যও দেন-দরবার শুরু করে দিয়েছেন।

দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে মাসুদ বিশ্বাসের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তির গ্রেপ্তার যখন বড় একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, তখন তার সহযোগী দেলোয়ারের অব্যাহত প্রভাব বিস্তার ও ব্যাংকে টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ

আরও পড়ুন