ইজি ফ্যাশনের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, জমি দখল ও শ্রমিক হত্যা অভিযোগ


বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে ‘ইজি ফ্যাশন’ একটি বহুল পরিচিত নাম। তবে এই জনপ্রিয় পোশাক ব্র্যান্ডের উজ্জ্বল চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর চিত্র—যেখানে দুর্নীতি, প্রতারণা, জমি দখল ও নির্যাতনের অভিযোগে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটির তিন শীর্ষ কর্ণধার। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার সান্তানপাড়া গ্রামের আব্দুল করিম চৌধুরীর তিন ছেলে—চেয়ারম্যান আসাদ চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইছাদ (ইসহাক) চৌধুরী ও পরিচালক তৌহিদ চৌধুরী—একাধিক অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন।
জমি দখলের জন্য উত্তরাধিকার সনদ জালিয়াতি
২০১৮ সালে এই তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে জমি দখলের উদ্দেশ্যে উত্তরাধিকার সনদ জালিয়াতি করে ভুয়া দলিল তৈরি করে জমি রেজিস্ট্রি করার অভিযোগ ওঠে। ডাঙ্গা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন জানান, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেশের বাইরে থাকাকালে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুযোগে তার সই জাল করে ইজি ফ্যাশনের কর্ণধাররা উত্তরাধিকার সনদ তৈরি করেন। এই জাল সনদ ও দলিলের মাধ্যমে তারা মোট ৪ বিঘা জমি আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ।
জালাল উদ্দিন বলেন, “আমার সই জাল করেছে এটা সত্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম, কিন্তু টাকার জোরে তারা মামলা থেকে খালাস পায়। আপিল করতে চেয়েও পারিনি। ওদের সঙ্গে পারা যায় না। ওদের টাকা আছে, ক্ষমতা আছে।” তিনি জানান, এই জমি দখলের বিষয়টি জানার পর তদন্ত শুরু করেন এবং অনেকের জমি দখলের তথ্যও বেরিয়ে আসে।
শতাধিক পরিবারের জমি চলে গেছে দখলে
ভিরিন্দা, সান্তানপাড়া, রঘুনাথপুরসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে অনুসন্ধানে জানা যায়, এই তিন ভাই প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষের জমি, বসতভিটা ও ফসলি জমি নানা কৌশলে দখলে নিয়েছেন। কারো জমির দলিলে স্বাক্ষর জাল করে, কারো মালিকানা দাবির নথি তৈরি করে, আবার কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে নেন বলে অভিযোগ। স্থানীয়রা জানান, তারা প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো মামলা খেয়ে হয়রানির শিকার হন।
একটি ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, সুরেন্দ্র চন্দ্র মিশ্রের সন্তান ললনা মিশ্রকে দাতা দেখিয়ে ১৬.৫ শতক জমি দখল করা হয়। একইভাবে নয়ন কুমার দাস, স্বর্দীপ চন্দ্র মিত্র, মৃণাল কান্তি মিশ্র, নব কৃষ্ণ মিত্র প্রমুখদের নাম ব্যবহার করে ভুয়া দলিলে আরও শত শত শতক জমি দখল করেন তারা। প্রতিটি দলিলে ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিনের ভুয়া স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়।
মামলা, গ্রেফতার ও জামিন
২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল জমি জালিয়াতির ঘটনায় জালাল উদ্দিন একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসাদ, ইছাদ ও তৌহিদ চৌধুরীকে আসামি করা হয়। সেই বছরের ১৯ জুন নরসিংদীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তবে তারা কিছুদিন পর জামিনে মুক্তি পান। মামলাটি পরে উচ্চতর আদালতে খারিজ হয়ে যায়।
পলাশ থানার ওসি বলেন, “২০১৮ সালের কোনো মামলা বর্তমানে পেন্ডিং নেই। চাইলে কোর্টে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।”
সাংবাদিককে প্রকাশ্য হুমকি
এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে ইজি ফ্যাশনের পরিচালক তৌহিদ চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া ছিল রীতিমতো ভয়ংকর ও অশালীন। তিনি বলেন, “যে লোকে এসব বলছে, তাকে বেঁধে আমাকে খবর দেন। আমি আইসা দেখাই, ওরে উল্টা করে নিচের দিকে মাথা দিয়া রাখি!” এমন হুমকি শুধু একজন সাংবাদিক বা সাধারণ ব্যক্তিকেই নয়, বরং যে কারো বিরুদ্ধে তিনি প্রয়োগ করতে প্রস্তুত—এমন ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার বক্তব্যে।
শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
২০১৯ সালে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা সামনে আসে। রাজধানীর মালিবাগ হাজীপাড়ায় ইজি ফ্যাশনের কাটিং সহকারী দেলোয়ার হোসেন সাঈদকে চুরির সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় নিহতের মামা আবু তাহের বাদী হয়ে ইজি ফ্যাশনের মালিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনকে আদালতে হাজির করা হলে তাদের রিমান্ড নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। আসামি আসাদ চৌধুরী, ইছাদ চৌধুরী ও তৌহিদ চৌধুরীসহ কয়েকজন পলাতক ছিলেন। এলাকাবাসী ও শ্রমিকদের মতে, এই মৃত্যু শুধু একটি দুর্ঘটনা নয় বরং ইজি ফ্যাশনের অভ্যন্তরীণ নির্যাতনের বহিঃপ্রকাশ।
স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশা
ডাঙ্গা ইউনিয়নসহ আশেপাশের এলাকাগুলোর সাধারণ মানুষ এখন আতঙ্কে বসবাস করছেন। অনেকে বলছেন, “ওদের বিরুদ্ধে কিছু বললে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়। টাকা ও ক্ষমতার জোরে সব ঠিক করে নেয়।” অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললে কেবল হুমকি নয়, বাস্তব ক্ষতিও সহ্য করতে হয়েছে অনেককে।
আইনের শাসনের প্রশ্ন
একদিকে বহু ভুক্তভোগী পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অপরাধীরা জামিনে মুক্ত হয়ে প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেন। এটি বাংলাদেশের আইনের শাসনের প্রশ্নকে বড়সড়ভাবে সামনে এনে দেয়। পুলিশের উদাসীনতা, আদালতের মামলার খারিজ, প্রভাবশালীদের তদবির—সব মিলিয়ে ন্যায়বিচার যেন এক অলীক কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি নামী পোশাক ব্র্যান্ডের আড়ালে যদি এভাবে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে, তাহলে সেটি কেবল ব্যবসায়িক অনিয়ম নয়, বরং একটি সমাজ ধ্বংসের রূপরেখা। ইজি ফ্যাশনের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে ওঠা জমি দখল, জালিয়াতি, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগগুলো গভীর অনুসন্ধান ও কঠোর আইনগত ব্যবস্থার দাবি রাখে।
এখন প্রশ্ন হলো—প্রভাবশালীদের জালিয়াতির ফাঁদে পড়ে যে পরিবারগুলো নিঃস্ব হলো, তাদের জন্য বিচার কি আদৌ সম্ভব? না কি টাকা আর প্রভাবের কাছে আবারও হার মানবে ন্যায়বিচার?
ইজি ফ্যাশনের রাজস্ব ফাঁকি নিয়ে আমাদের অনুসন্ধান চলছে, বিস্তারিত পরবর্তী প্রতিবেদনে থাকবে।
(গত ১৯ মে প্রিন্ট ভার্সনে প্রকাশিত প্রতিবেদন)
