ঋতুপর্ণার জোড়া গোল: দারিদ্র্য পেরিয়ে বিজয়ের গল্প


অসাধারণ সাফল্যে নতুন ইতিহাস লিখল বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। বাছাইপর্বে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো নারী এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে লাল-সবুজের মেয়েরা।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে স্বাগতিক মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়ে সি-গ্রুপের শীর্ষে ওঠে বাংলাদেশ। একই দিন গ্রুপের আরেক ম্যাচে বাহরাইন ও তুর্কমেনিস্তান ২-২ গোলে ড্র করলে নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়া এবং মূল পর্বে উঠা।
এই সাফল্যের মধ্য দিয়ে ২০২৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য নারী এশিয়ান কাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। শুধু তাই নয়, এই টুর্নামেন্ট ২০২৭ নারী বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব হিসেবেও কাজ করবে, ফলে বড় মঞ্চে খেলার দরজাও খুলে যেতে পারে বাংলাদেশের সামনে।
ঋতুপর্ণা চাকমার জোড়া গোল, দলের দুর্দান্ত সংহতি এবং আত্মবিশ্বাসী পারফরম্যান্স বাংলাদেশের নারী ফুটবলের উত্থানের প্রমাণ রাখলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এই অর্জন শুধু একটি টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ নয়, বরং দেশের নারী ক্রীড়ার ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হলো।
নতুন ইতিহাস গড়ার নায়িকা হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলের এক উজ্জ্বল নাম—ঋতুপর্ণা চাকমা। মিয়ানমারের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২-১ ব্যবধানের ঐতিহাসিক জয়ে দুই গোল করে দলকে প্রথমবারের মতো নারী এশিয়ান কাপের মূল পর্বে তুলেছেন এই তরুণী। আর দুটো গোলই এসেছে তাঁর বাঁ পা থেকে—একটি ফ্রি কিকের রিবাউন্ড থেকে নিখুঁত প্লেসিংয়ে, আরেকটি দুর্দান্ত অ্যাঙ্গেলে নেওয়া শটে, যা মিয়ানমারের গোলরক্ষক শুধু তাকিয়ে দেখেছেন।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন যেমন বলেছে, ‘দুই গোল, এক তারকা’—ঋতু যেন সত্যিই এই ম্যাচের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে তীব্র শোক, দারিদ্র্য, পারিবারিক সংকট আর অদম্য সংগ্রামের গল্প।
মাত্র তিন দিন আগে ছোট ভাই পার্বণ চাকমার মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ২০২২ সালে মারা যান পার্বণ। ভাইয়ের সেই শোক এখনও বুকে ধরে রেখেছেন ঋতু। কিন্তু মাঠে নামলে শোককে রূপ দেন শক্তিতে। বাহরাইনের বিপক্ষে ম্যাচের দিনও ভাইয়ের ছবি দিয়ে প্রার্থনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তার তিন দিনের মাথায় দেশের জন্য এনে দেন সবচেয়ে বড় সাফল্য।
রাঙামাটির প্রত্যন্ত গ্রাম মগাছড়িতে বেড়ে ওঠা ঋতু শৈশবেই খেলাধুলায় ঝোঁকেন। মাঠে খেলতে গিয়ে পায়ের নখ পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। কিন্তু থামেননি। পাশে পেয়েছিলেন স্কুলশিক্ষক বীরসেন চাকমাকে, যিনি তার প্রতিভায় বিশ্বাস রেখেছিলেন।
পিতৃহারা, অভাবগ্রস্ত সংসারে বেড়ে ওঠা ঋতু ছোটবেলায় কখনো ভাবেননি একদিন জাতীয় দলের তারকা হবেন। তাঁর বাবা বরজ বাঁশি চাকমা ছিলেন একজন কৃষক, যিনি ক্যানসারে মারা যান। সেসময় নেমে আসে ভয়াবহ আর্থিক সংকট। তবু মেয়েটি লড়াই করে গেছেন, করে যাচ্ছেন।
আজকের ঋতুপর্ণা শুধু মাঠে গোল করেন না, গোল করেন জীবনের প্রতিটি বাধার বিরুদ্ধে। তাঁর বাঁ পা শুধু ফুটবল শট নেয় না, তা হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের, জেদের ও স্বপ্নের প্রতীক। দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের মানচিত্রে বাংলাদেশের নামটা প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম এখন এই পাহাড়ি তরুণী।
এই ঋতু প্রমাণ করে দিয়েছেন—শুধু পা দিয়ে নয়, সাহস দিয়েও ইতিহাস লেখা যায়।
